পৃথিবীর সব দেশের সংবিধানে সীমিত ও শর্তায়িত বাক ও মতের স্বাধীনতার কথা বলা আছে। বাকস্বাধীনতা মানে গালাগালি, মিথ্যা, ইতিহাস বিকৃতি না, অশালীন বক্তব্য করা নয়। অমর্ত্য সেন একবার বলেছিলেন, বাকস্বাধীনতা প্রকৃতপক্ষে মানব স্বাধীনতারই গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অন্যের সঙ্গে কথা বলতে পারা, অন্যের কথা শুনতে পারার সক্ষমতা। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে এসে এখনো স্বাধীন দেশে বাকস্বাধীনতার নামে ছড়ানো হয় সাম্প্রদায়িক হিংসা। আর এই উদ্ভূত পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। কোনো নাগরিকের বাকস্বাধীনতার ব্যবহারের কারণে যদি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরিস্থিতি তৈরি হয়, সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় বা অন্য দেশের সঙ্গে সম্পর্কের ওপর বিরূপ প্রভাবের উপক্রম হয়, তখন দেশের আইন অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা করতে পারবে। সাংবিধানিক মৌলিক আদর্শবোধকে রক্ষা করার স্বার্থেই তা প্রয়োজন। একজন ব্যক্তি যদি বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে, তাহলে কি তাকে আইনের আওতায় আনা ন্যায়সংগত হবে না? আমাদের সংবিধানে যে মৌলিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে বাকস্বাধীনতা একটি। তবে এই ধারায় একটি সাব-ক্লজ আছে। যেখানে বলা হয়েছে, এই স্বাধীনতা কখনোই অবাধ নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে যে সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন। সংবিধানে বাক ও ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ে যে অধিকার দেওয়া হয়েছে, তা প্রথমটির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা, নৈতিকতা, আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে এবং শেষটির ক্ষেত্রে আইন-জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতা সাপেক্ষে। একসময় দুর্নীতি, খাদ্য ঘাটতি, বিদ্যুৎ ঘাটতি আর জঙ্গিবাদের দেশে পরিণত হয়েছিল এই দেশ। কিন্তু আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছি। দেশ আজ খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশ, বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ। বাংলাদেশ আজ অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে বিশ্বের পাঁচটি দেশের একটি। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ গড়ে তোলার জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছে সরকার। দেশের সংকটময় পরিস্থিতিতে কিছু লোক গুজব রটিয়ে, উসকানি দিয়ে বাকস্বাধীনতার নামে দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলে অথচ যারা উন্নয়নের কথা তুলে ধরলে তারাই চাটুকার আর দালাল হিসেবে আখ্যায়িত হয় সেসব ব্যক্তির দ্বারা। আর অন্যের বাকস্বাধীনতা হরণ করে তাদের এই স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচারিতার নামান্তর। যখনই উন্নয়ন নিয়ে কথা বলা হয়, কিছু ব্যক্তি তাদের দালাল এবং চাটুকার নানা নামে আখ্যায়িত করে থাকে। তাদের ক্ষেত্রে কখনো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যবহার হতে দেখিনি। যারা একতা ও ভ্রাতৃত্ববোধে আঘাত হানে এবং সেটাকে বাকস্বাধীনতার নামে চালানোর চেষ্টা করে, তাদের আইনের আওতায় আনা হয় না। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এটি আমাদের জন্য বড় লজ্জা। বাকস্বাধীনতা ও বিরুদ্ধ মত অবশ্যই কাম্য, তবে তা যখন অন্য নাগরিকের বাকস্বাধীনতা হেয় করে, সমাজে তাকে নিচু করা হয়, তাকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করা হয়, তখন কি সেটাকে বাকস্বাধীনতা বলা যায়?