যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের অনেক দেশ, এমনকি ভারতেরও কোনো কোনো এলাকায় এরই মধ্যে করোনার টিকার সুফল মিলতে শুরু করেছে। তবে বাংলাদেশে টিকার সুফল ঠিক কবে নাগাদ দৃশ্যমান হতে পারে, তা এখনো বলার পর্যায়ে আসেনি, বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে তাঁদের মতে, যত দ্রুত বেশিসংখ্যক মানুষকে টিকার আওতায় আনা যাবে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা যাবে, তত দ্রুত সাফল্যের দেখা মিলবে। ফলে সবাইকেই টিকা নিতে হবে এবং টিকা নেওয়ার পরও আগের মতোই সুরক্ষাব্যবস্থা বজায় রাখতে হবে। বিশেষ করে মাস্ক ছাড়া চলাফেরা করাই যাবে না এবং অন্য সব স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। কিন্তু দেশে টিকা দেওয়ার গতি বাড়ছে না, বরং কমছে। এ কারণে আশার আলো অনেকটা দূরেই রয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। তাঁরা বলছেন, দেশে টিকার সাফল্য নির্ভর করছে বহু সূচক ও সমীকরণের ওপর। তবে টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার মাসখানেক পর থেকে টিকা নেওয়া বয়স্কদের মধ্যে করোনায় মৃত্যু কমে আসবে বা ইতিবাচক ফল দেখা যাবে। এদিকে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) সূত্র জানায়, দেশে এ পর্যন্ত যে ৫০ লাখ মানুষ করোনার টিকা নিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ১ শতাংশেরও কম মানুষ এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তা-ও হয়েছেন নিজেদের অসাবধানতা বা অসতর্ক আচরণের কারণে। কারণ টিকার প্রথম ডোজ দেওয়ার পরপরই পর্যাপ্ত অ্যান্টিবডি তৈরি হয় না। এ জন্য সময় প্রয়োজন হয় এবং ধীরে ধীরে অ্যান্টিবডি বাড়তে থাকে। এরই মধ্যে দেশে আট হাজার ৭০০ জনের অ্যান্টিবডি দেখার জন্য কার্যক্রম শুরু করেছে আইইডিসিআর। সাত ধাপে টানা দুই বছর ধরে চলবে এই গবেষণা। রোগতত্ত্ববিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘১৭ কোটি মানুষের দেশে আমরা মাত্র ৫০ লাখ মানুষকে টিকা দিতে পেরেছি। এর শতকরা হার দেখলে বলতে গেলে কিছুই না। যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপে যেহেতু লোকসংখ্যা কম, তাই সেখানে টিকা দেওয়াও শেষ হবে দ্রুত এবং সাফল্যও দ্রুত মিলবে—এটাই স্বাভাবিক। আমাদের দেশে যতটা সম্ভব দ্রুত বেশিসংখ্যক মানুষকে একই সময়ে টিকা দেওয়া শেষ করা যাবে, ততই ভালো।’ এই রোগবিজ্ঞানী বলেন, ‘যদি বিষয়টি এমন হয় যে একাংশ মানুষ টিকা নিলেন, আরেক অংশ নিলেন না বা নিতে দেরি হলো, তবে এর কার্যকারিতা সমানভাবে প্রতিফলিত হবে না। বিশেষ করে ইউরোপে যেভাবে হার্ড ইমিউনিটির কথা বলা হচ্ছে, সেই মাত্রায় আমাদের এখানে হার্ড ইমিউনিটির কথা ভাবা যাবে না।’ তাঁর মতে, ‘যেসব দেশে টিকা দেওয়ার পর সংক্রমণ নিচের দিকে নেমেছে, সেটা কত দিন থাকে তা-ও পর্যবেক্ষণের ব্যাপার আছে। কারণ এখনো আমরা নিশ্চিতভাবে জানি না টিকা দেওয়ার পর যে অ্যান্টিবডি তৈরি হবে, সেটার স্থায়িত্ব কত দিন হবে। তাই আমরা টিকার ওপর যেমন জোর দিচ্ছি, তেমনি একই সঙ্গে টিকা দেওয়ার পরেও পরিপূর্ণভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বলছি।’ আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, সংক্রমণের ওপর ইতিবাচক ফল অনশ্চিত হলেও অন্য দেশের ওপর পর্যবেক্ষণ থেকে বলাই যায়, দ্বিতীয় ডোজ টিকা নেওয়ার মাসখানেক পর থেকে বয়স্ক জনগোষ্ঠীর মধ্যে যাঁরা টিকা নিয়েছেন, তাঁদের করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু কমে আসবে। আর যেহেতু দেশে এখন করোনায় যারা মারা যাচ্ছে তাদের বড় অংশই বয়স্ক, ফলে তাঁদের মৃত্যু কমলে তা মোট মৃত্যু কমিয়ে আনতে ইতিবাচক প্রভাব রাখবে। আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. এ এস এম আলমগীর কালের কণ্ঠকে বলেন, যাঁরা টিকা নিয়েছেন তাঁদের ১ শতাংশেরও কম করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। অন্যান্য দেশেও এই হারেই আক্রান্ত হয়েছেন টিকা নেওয়া ব্যক্তিরা। তবে কোথাও এর দায় কোনোভাবেই টিকার নয়। বিশ্বের কোথাও টিকার কারণে কারো শরীরে করোনাভাইরাস সংক্রমিত হয়নি। বাংলাদেশেও কেউ টিকার কারণে আক্রান্ত হননি। টিকা দিতে যাওয়ার সময়, টিকাকেন্দ্রে ঠেলাঠেলি বা ভিড়ের কারণে কিংবা টিকা দেওয়ার পর নিজেকে করোনাজয়ী হিসেবে ধরে নিয়ে বেপরোয়া চলাফেরার কারণেই তাঁরা আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি বলেন, যারা বিভিন্ন হাসপাতালে এখন ভর্তি হচ্ছে, তাদের মধ্যে যাঁদের টিকা নেওয়া আছে, সেই মানুষগুলোর প্রায় সবাই টিকা নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় অসতর্কভাবে ঘুরে বেড়িয়েছেন। ফলে তাঁরা নিজেরাও যেমন আক্রান্ত হয়েছেন, আবার তাঁদের মাধ্যমেও অনেকেই আক্রান্ত হয়েছে। ড. আলমগীর বলেন, ‘আমরা সাত ধাপে গবেষণা শুরু করেছি টিকা নেওয়ার পর অ্যান্টিবডি লেভেল দেখার জন্য। এটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। সাত হাজার ৭০০ জন মানুষের প্রতিজনের কাছ থেকে দুই বছরে আটবার করে নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করতে হবে। এটা এক-দুই দিন কিংবা আট-দশজন মানুষের অ্যান্টিবডি লেভেল দেখেই ফলাফল জানানোর মতো বিষয় নয়।’ তিনি জানান, যে আট হাজার ৭০০ মানুষের নমুনা নেওয়া হবে তাঁরা প্রথমবার নমুনা দেবেন টিকা নেওয়ার আগে, দ্বিতীয়বার দেবেন প্রথম ডোজ নেওয়ার ২১-২৮ দিন পরে, এরপর দেবেন দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার ১৪ দিন পরে, এরপর তিন মাস পরে, এরপর ছয় মাস পরে, এরপর ১২ মাস পরে, এরপর ১৮ মাস পরে এবং সর্বশেষ ২৪ মাস বা দুই বছর পরে। এভাবেই চূড়ান্ত ফল পাওয়া যাবে—টিকা আমাদের কতটা সুরক্ষা দিচ্ছে বা দিচ্ছে না; যার মধ্য দিয়ে টিকা থেকে সৃষ্ট অ্যান্টিবডির মাত্রা ও স্থায়িত্বসহ আরো অনেক বিষয়ই বেরিয়ে আসবে। এটি একটি বিশ্বমানের গবেষণা হচ্ছে। এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে গতকাল বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত টিকার জন্য নিবন্ধন করেছেন ৬৪ লাখ ৬৭ হাজার ৭৭৯ জন। এর মধ্যে টিকা নিয়েছেন ৪৯ লাখ ৫৮ হাজার ২৭৫ জন। গতকাল টিকা নিয়েছেন ৭৮ হাজার ৮১৭ জন।