সম্প্রতি লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর পর কারাগারে মৃত্যু নিয়ে ব্যাপক উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। জেলখানায় মৃত্যুর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কর্তৃপক্ষ স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে বলেই দাবি করলেও অনেক ক্ষেত্রেই মৃতের পরিবার, মানবাধিকার সংস্থা এমনকি সাধারণ মানুষের কাছে এসব মৃত্যু কতটা স্বাভাবিক তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে কারাগারে ৭৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের পরিসংখ্যান বলছে, গত ৫ বছরে জেলখানায় মারা গেছেন কমপক্ষে ৩৩৮ জন বন্দি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটক লেখক মুশতাক আহমেদ জামিন না পেয়ে দশমাস কারাবন্দি থাকা অবস্থায় মারা যান। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি রাত সোয়া ৮টার দিকে অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তাঁর মৃত্যুকে সরকারের পক্ষ থেকে স্বাভাবিক মৃত্যু হিসেবে দাবি করা হয়। এ বছরই কিশোরগঞ্জের এক ব্যক্তি নেশা ছাড়াতে ছেলেকে কারাগারে পাঠিয়েছিলেন সংশোধনের জন্য, দুমাস না যেতেই ফেরত পেয়েছেন ছেলের লাশ। এছাড়া ২০১৯ সালে পঞ্চগড় জেলা কারাগারে আগুনে পুড়ে মারা যায় আইনজীবী পলাশ কুমার রায়। তদন্তে এই মৃত্যুকে কর্তৃপক্ষ আত্মহত্যা বলে জানায় যদিও পলাশের পরিবারের কাছে শুরু থেকেই এ তদন্ত প্রতিবেদন ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। কারাবন্দি কোন ব্যক্তির মৃত্যু হলে কতটা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত হয় – তা নিয়ে যেমন প্রশ্ন থাকে সেই সাথে জেলখানায় বন্দিরা কতটা চিকিৎসা সুবিধা পায় সেটা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। কারাগারে একাধিক মৃত্যু দেখেছেন এমন একজন তার অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, জেলখানায় মৃত্যুগুলোকে তার ভাষায় কোনভাবেই স্বাভাবিক মৃত্যু বলার সুযোগ নেই। “প্রচণ্ড পরিমাণ একটা মেন্টাল টর্চারের মধ্যে থাকতে হয় জেলের মধ্যে। মানসিক চাপের মধ্যেও থাকতে হয়। এত মানসিক নির্যাতনের মধ্যে স্বাভাবিক মৃত্য হতে পারে না। আমি মনে করি এগুলো স্বাভাবিক মৃত্য না।” নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যক্তি একাধিক কারাগারে দীর্ঘদিন জেল খেটেছেন। কারাবাসের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি ধারণা দেন জেলখানার স্বাস্থ্যসেবা নিয়েও। তিনি বলেছেন, “কিছু সরকারি গতানুগতিক ওষুধ আছে। আপনার দাঁতে ব্যথা হলে যে ওষুধ, মাথা ব্যথা হলেও একই ওষুধ। আর ট্রিটমেন্টটাও ঠিকমতো হয় না। তিনি আরো বলেন, “জেলখানাতে একটা হসপিটাল আছে। বাট সে হাসপাতালে থাকতে হলে আপনার টাকা থাকতে হবে। হঠাৎ যদি কেউ অসুস্থ্য হয়ে পড়ে, তাহলে পারমিশন লাগবে। সেই পারমিশন নিতে নিতে যদি আপনি মারা যান, তাহলে আর তো ট্রিটমেন্ট নেয়ার দরকার নাই। বলা হবে স্বাভাবিক মৃত্যু।” জেলখাটা ওই ব্যক্তির অভিজ্ঞতার সাথে মিল পাওয়া যায় দেশের বিভিন্ন কারাগারে বহু বছর কাজ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এক ব্যক্তির সঙ্গে বিস্তারিত আলাপে। তিনি বলেন, ‘সমাজের অপরাধীদের শৃঙ্খলার মধ্যে রাখার স্বার্থে কারাগারে কঠোর অনুশাসন আর শাস্তির ব্যবস্থা আছে। তবে তার অভিজ্ঞতায় জেলখানায় মৃত্যুর কারণ হল- বাইরে থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে আসা, কারাগারের পরিবেশ, ডাক্তার এবং সময়মতো চিকিৎসার সংকট।’ কারাগারে একজন রোগী অসুস্থ হলেও প্রাথমিক পর্যায়ে খুব একটা আমলে নেয়া হয় না জানিয়ে তিনি বলেন, “যখন চূড়ান্ত অসুস্থ্য হয়ে পড়েন, তখন দৌড়-ঝাপ শুরু হয়। আর আরেকটি কারণ হল- প্রকৃত অসুস্থ রোগীরা হাসপাতালে জায়গা পায় না। প্রভাবশালীরাই কারা হাসপাতালে বেড পায়। যাদের টাকা আছে, তারা বেড পায়।” “আর চাইলেই কিন্তু একজন রোগী কারাগারে চিকিৎসা নিতে পারে না। তাকে অনুমোদনের দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। যখন বন্দি মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়ে, তখন কর্তৃপক্ষ বাইরে হাসপাতালে পাঠায়”। তবে কারাগারে মৃত্যু হলে সেগুলো তদন্ত করা হয় বলে দাবি করেছেন কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ মোমিনুর রহমান মামুন। তিনি বলেন, “যেহেতু তাদের উপস্থিতিতে মৃত্যু হয় নাই, তো এখানে তাদের মধ্যে এই অভিযোগটা থাকতেই পারে। কিন্তু আমরা কিন্তু সর্বোচ্চ চেষ্টা করি যে সঠিকভাবে তদন্ত করে সঠিক জিনিসটাকে উপস্থাপনের চেষ্টা করি। তার মধ্যেও আমাদের ভুল ত্রুটি থাকতে পারে- সেটা অস্বীকার করবো না।” মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র জেলখানায় মৃত্যু নিয়ে কারা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে। বন্দি মৃত্যু নিয়ে তাদের চিঠির যে জবাব আসে সেগুলোতেও গৎবাঁধা স্বাভাবিক মৃত্যু অথবা আত্মহত্যার উল্লেখ থাকে। সংগঠনটির সিনিয়র উপপরিচালক নীনা গোস্বামী বলেন, “প্রায় প্রতিটি মৃত্যুর ঘটনাই আমরা জেল কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চাই যে কী ঘটেছিল। সঠিক তদন্ত হয়েছে কিনা, তদন্ত হলে রিপোর্ট কী?” “অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা উত্তরও পাই। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বলা হয় স্বাভাবিক মৃত্যু। কিন্তু উত্তর পেলেও আমাদের জিজ্ঞাসা থেকেই যায়। যে স্বাভাবিক মৃত্যু হলেও যথেষ্ট পরিমান তাকে চিকিৎসা দেয়া হয়েছিল কিনা। যে যে অধিকার জেলখানাতে পাওয়ার কথা সেগুলো সে পেয়েছিল কিনা।” কারাগারে চিকিৎসা ঘাটতি আছে স্বীকার করে কারা মহাপরিদর্শক বলেন, “আমাদের কাশিমপুরে ২০০ শয্যা বিশিষ্ট একটা হসপিটাল আছে। সেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কিন্তু থাকার কথা। কিন্তু দেখেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাবে আমরা কিন্তু সেটি পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করতে পারছি না বা করছি না।” ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ মোমিনুর রহমান মামুন বলেন, “সবমিলিয়ে আমাদের যে চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকা দরকার সেখানে কিছুটা ঘাটতি আছে। এজন্য আমাদের বাইরের হসপিটালগুলোর ওপর বেশি নির্ভর করতে হয়। পরিস্থিতির উন্নতির জন্য সুযোগ সুবিধা বাড়ানোর জন্য এবং চিকিৎসা সরঞ্জামাদি এবং ওষুধ যেন তারা নিশ্চিতভাবে পায় এ বিষয়গুলো আমরা চেষ্টা করছি।”