বাংলাদেশের অব্যাহত উন্নতি ও অগ্রগতির জোরালো প্রশংসা করেছেন ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং। তিনি বলেছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশকে বিশ্বের জনগোষ্ঠীর কাছে বলার একটি ভালো গল্প দিয়ে গেছেন। গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় ঢাকায় জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে ‘মুজিব চিরন্তন’-এর অষ্টম দিনের অনুষ্ঠানের সম্মানিত অতিথি হিসেবে দেওয়া বক্তব্যে লোটে শেরিং এসব কথা বলেন। আর অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক নেতা এবং নীতিনির্ধারকদের শান্তিপূর্ণ সমৃদ্ধ দক্ষিণ এশিয়া গড়ে তুলতে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। ভুটানের প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ‘যতবারই বাংলাদেশে আসি অগ্রগতি চোখে পড়ে। বিশেষ করে গত এক দশকে অর্থনৈতিকভাবে যে অগ্রগতি হয়েছে তা প্রশংসনীয়। মহামারি সত্ত্বেও আপনারা এই মহাদেশে অন্যতম সর্বোচ্চ জিডিপি অর্জন করেছেন। এ জন্য আপনাদের অভিনন্দন।’ বক্তব্যের শুরুতেই লোটে শেরিং ভুটানের মহামান্য রাজা, রানি, জনগণ ও সরকারের পক্ষে বাংলাদেশের সরকার ও বন্ধুপ্রতিম জনগণের প্রতি শুভেচ্ছা জানান। তিনি বলেন, “বাংলাদেশে ফিরে আসা সব সময় আনন্দের। বাংলাদেশকে আমার ‘সেকেন্ড হোম (দ্বিতীয় বাড়ি)’ বলি। এবার বাংলাদেশে আসার কারণটা আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ।” তিনি বলেন, ‘দুটি বিশেষ উদযাপনের জন্য আমি এখানে এসেছি। আপনারা সবাই জানেন, আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী পালন করছি এবং তিনি যে দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন সেই দেশের ৫০ বছর উদযাপন করছি।’ ভুটানের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আমাদের সবার জন্য, বিশ্বের সব রাষ্ট্রের জন্য অবশ্যই বলার মতো একটি গল্প থাকা প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশকে বিশ্বের জনগোষ্ঠীর কাছে বলার একটি ভালো গল্প দিয়েছেন। আমি আজ এত গর্বিত যে আমি সেই গল্প শুনতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশের আসনে বসার সুযোগ পেয়েছি। আমি খুব গর্বিত, কারণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একজন অনুপ্রেরণাময়ী নেত্রী। তিনি আমার কাছে মায়ের মতো।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভার্চুয়াল আলোচনার উল্লেখ করে তাঁর দেওয়া উৎসাহ ও পরামর্শের কথা স্মরণ করেন লোটে শেরিং। তিনি বলেন, ‘অনেক দূরত্বে থাকার পরও আমি বাংলাদেশের জনগণকে নিয়ে তাঁর (শেখ হাসিনার) মধ্যে এত উদ্বেগ ও আগ্রহ অনুভব করি। তাঁকে নেত্রী হিসেবে পেয়ে বাংলাদেশ সত্যিই সৌভাগ্যবান।’ ভুটানের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ ও তাঁর মেয়ে শেখ হাসিনাকে নিয়ে গর্বিত—এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।’ এবারের সফর প্রসঙ্গে লোটে শেরিং বলেন, ‘আমাদের অনেক দ্বিপক্ষীয় সম্পৃক্ততা আছে। এবার আমি বাংলাদেশে এসেছি শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এবং শান্তিপূর্ণ, স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে তাঁর দেওয়া শক্ত ভিত্তির উত্তরাধিকারকে সম্মান জানাতে।’ তিনি বলেন, ‘আমি একজন কন্যাকে সম্মান জানাতে এসেছি যিনি তাঁর বাবার স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবায়নে জোরালো অঙ্গীকার নিয়ে কাজ করছেন। আগে যেমন বলেছি, তিনি এমন এক নেতা যিনি তাঁর জনগণের স্বাধীনতা ও সুখকে সব কিছুর ঊর্ধ্বে রেখেছেন। বাংলাদেশ সব পর্যায়ে অগ্রগতি করেছে।’ ভুটানের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের উন্নয়ন পূর্বাভাস আরো চমৎকার। বাংলাদেশ ও বাংলাদেশিদের ভবিষ্যৎ অনেক উজ্জ্বল। বাংলাদেশ যে অগ্রগতি করেছে, তা নিয়ে আমরা গর্বিত। কারণ আমরা জানি, বাংলাদেশের শক্তিশালী অর্থনীতি ভুটানসহ এই অঞ্চলের অর্থনীতিতে আরো গতি সঞ্চার করবে।’ ভুটানের রাজার ‘গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস’ দর্শনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’ দর্শনের সাদৃশ্য তুলে ধরেন লোটে শেরিং। তিনি বাংলায় বলেন, “শেখ মুজিবুর রহমান ভেবেছিলেন ‘কারো সঙ্গে বিদ্বেষ নয়’। আর আমাদের রাজা ভেবেছিলেন, ‘শান্তি ও সম্প্রীতি সাফল্যের চাবিকাঠি।’ এ দুটি নির্দেশক দুই দেশকে এত কাছে এনেছে।” ঐতিহাসিক উদযাপনের অংশ হওয়ার সুযোগ দেওয়ার জন্য ভুটানের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর উত্তরাধিকার আজীবন বেঁচে থাকুক।’ লোটে শেরিং বলেন, “বাংলায় না বলে পারছি না। অন্নদাশঙ্কর রায় চমৎকারভাবেই লিখেছেন, ‘যত দিন রবে পদ্মা যমুনা গৌরি মেঘনা বহমান, তত দিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।’ এ কথাগুলো আমার বেশ ভালো লেগেছে।”
- শান্তিপূর্ণ দক্ষিণ এশিয়া গড়ার ডাক শেখ হাসিনার
অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক নেতা এবং নীতিনির্ধারকদের শান্তিপূর্ণ সমৃদ্ধ দক্ষিণ এশিয়া গড়ে তুলতে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ভুটানের স্বীকৃতি দেওয়ার কথা স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, সেদিন তাঁরা বন্দি অবস্থায় রেডিওতে সেই ঘোষণা শুনেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ এবং ভুটানের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ, পর্যটন, শিক্ষা ইত্যাদি খাতে সহযোগিতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভুটানি ছাত্র-ছাত্রী বাংলাদেশে চিকিৎসাশাস্ত্রসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে। প্রধানমন্ত্রী ডা. লোটে শেরিং ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে চিকিৎসাবিদ্যায় গ্র্যাজুয়েশন করেছেন। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের। ভুটানের মানবসম্পদ উন্নয়নে সহযোগী হতে পেরে আমরা গর্বিত।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শুধু বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যই লড়াই করেননি, তিনি বিশ্বের সকল নিপীড়িত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির স্বপ্ন দেখতেন। তিনি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে যেকোনো সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে প্রাপ্ত সম্পদকে কাজে লাগিয়ে আমরা সহজেই দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন ঘটাতে পারি। আমরা যদি আমাদের জনগণের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য সম্মিলিতভাবে কাজ করি, তাহলে অবশ্যই দক্ষিণ এশিয়া বিশ্বের মধ্যে অন্যতম সমৃদ্ধ অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে।’