পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তিনি আদমকে সব কিছুর নাম শিখিয়েছেন।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ৩১) পৃথিবীর প্রথম মানব আদম (আ.) তাঁর ইহলৌকিক জীবন শুরু করেছিলেন একজন জ্ঞানী, স্রষ্ঠার প্রতি অনুগত এবং একজন সাবলীলভাষী হিসেবে। কিন্তু আজকের বহু নৃ-তাত্ত্বিক ভাষাবিজ্ঞানীর দাবি, ‘পৃথিবীর প্রথম মানব ভাষা ব্যবহারে সক্ষম ছিলেন না। মনের ভাব প্রকাশে ইশারা-ভাষাই ছিল তাঁর একমাত্র অবলম্বন। তারা আরো বলেন, প্রথম মানব নির্দিষ্ট কোনো মতাদর্শেও বিশ্বাসী ছিলেন না, তিনি নিজের পরিচয় এবং পারিপার্শ্বিক পরিবেশ-পরিস্থিতি সম্পর্কে ছিলেন অজ্ঞ। পরে ধীরে ধীরে পশু-পাখির থেকে তিনি ভাষাজ্ঞান অর্জন করেন। আর প্রকৃতির বাহ্যিক পরিবর্তন এবং এর নেতিবাচক প্রভাব দেখে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে তিনি স্রষ্টায় বিশ্বাস স্থাপন করেন।’ এই ভুল ও অগ্রহণযোগ্য দাবির ভিত্তিতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মাইকেল কোরবালিস তাঁর গ্রন্থ ‘দ্য অরজিন্স অব ল্যাঙ্গুয়েজ : ফ্রম হ্যান্ড টু মাউথ’-এ উল্লেখ করেছেন, ‘আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে বর্তমানে প্রচলিত বেশির ভাগ ভাষা শুরুতে ইশারায় ব্যবহৃত হতো। পর্যায়ক্রমে যা শব্দে এবং নানা শব্দে রূপ নিয়েছে। কখনো শব্দের প্রকাশ-ই ভাষা সৃষ্টির প্রাথমিক মাধ্যম হয়েছে। কেননা উচ্চারিত এ শব্দমালা চেহারা, মুখ এবং দুই হাতের ইশারার সঙ্গে প্রতিধ্বনিত হতো।’ ভাষা সৃষ্টির মতো একটি বিষয়ে তার এই ভুল বিশ্লেষণের পেছনে রয়েছে জৈব বিবর্তনের ভুল বিশ্বাস দ্বারা প্রতারিত হওয়া। মাইকেল কোরবালিসের এই দাবি ইতিমধ্যে বৈজ্ঞানিকভাবেই রদ করা হয়েছে; বিশেষত জেনেটিকস, অণুজীব বিজ্ঞান এবং কোষবিদ্যার ক্ষেত্রে। ভাষা সৃষ্টির ব্যাখ্যায় তারা যে তত্ত্ব ও অনুমাননির্ভর অভিমত পেশ করেছে তা আমাদের আদি পিতা ও প্রথম মানব আদম (আ.)-এর সৃষ্টির বাস্তবতা, তাঁকে সৃষ্টিকালেই সব কিছুর নাম শিক্ষা দেওয়া এবং শারীরিকভাবেই তাঁকে বাকশক্তির অধিকারী করার বিষয়গুলো থেকে বহু দূরে। যদিও আমরা মেনে নিই যে ভাষাও পৃথিবীর সব জীব পদার্থের মতো বর্ধনশীল, তাহলে আমাদের পক্ষে এটাই যথেষ্ট যে সিরিয়াক এবং হিব্রুর মতো প্রাচীন দুটি ভাষার ৫০ শতাংশেরও বেশি শব্দের উৎপত্তি সরাসরি আরবি থেকে। সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয় যে বিশ্বে বেশি প্রচলিত পাঁচ হাজার ভাষার উৎসস্থলও আরবি, যে ভাষায় প্রথম মানব-মানবী আদম ও হাওয়া (আ.) কথা বলতেন। আর এ ব্যাপারেই পবিত্র কোরআন, হাদিস এবং মনীষীদের অভিমতের সমর্থন রয়েছে। কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে, ‘আর তিনি আদমকে সব কিছুর নাম শিখিয়েছেন।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ৩১) আল্লাহ আরো বলেন, ‘দয়াময় আল্লাহ, কোরআন শিখিয়েছেন। মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। তাদের ভাষা (ও অভিব্যক্তি) শিক্ষা দিয়েছেন।’ (সুরা আর রহমান, আয়াত : ১-৪) এসব আয়াতে মানুষকে পূর্ণতা দিয়ে সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। সৃষ্টিগতভাবেই তাঁকে দান করা হয়েছে স্পষ্ট শ্রবণশক্তি এবং সাবলীল কথা বলার যোগ্যতা। একই সঙ্গে তাঁর নিখুঁত সৃষ্টিতে হুকুম পরিপালনের সামর্থ্যও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু নাস্তিকরা, যারা স্রষ্টায় বিশ্বাসী নয়; সব কিছুকে তারা দেখে প্রকৃতি থেকে। ‘প্রকৃতি’ শব্দটিকে সঠিকভাবে সজ্ঞায়িত করতে পারেনি; বরং শব্দটি তারা আবিষ্কারই করেছে স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির সম্পর্ক—এই বিষয়টি থেকে দূরে থাকার জন্য। মুসলিম সম্প্রদায় বিশ্বাস করে যে মানুষ সৃষ্টিগতভাবেই জ্ঞানী, স্রষ্টায় অনুগত, বাকশক্তির অধিকারী, চিন্তাশীল এবং আল্লাহ তাঁকে আরো যেসব গুণাবলি দিয়ে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছেন তার সবই প্রথম মানব আদম (আ.)-এর মধ্যে বিদ্যমান ছিল। কেননা আল্লাহ তাঁকে সৃষ্টি করেছিলেন এক মহান উদ্দেশ্যে। তা হলো, পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব প্রতিষ্ঠা করা। তিনি বলেন, ‘আমি পৃথিবীতে একজন প্রতিনিধি নিযুক্ত করতে যাচ্ছি।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ৩০) ভাষা বস্তুগুলোর নাম জানার মাধ্যম। আর আল্লাহ আদম (আ.)-কে জান্নাতে সব বস্তুর নাম শিখিয়েছিলেন এবং তাঁর মস্তিষ্কে প্রতিটি বস্তুর বাস্তব রূপ চিত্রায়িত হয়েছিল। অতঃপর পৃথিবীতে আগমনের পর তিনি মানবীয় স্মৃতিশক্তির দ্বারা সব বস্তুর পরিচয় নির্ধারণ করেন। আদম (আ.)-এর সঙ্গে ফেরেশতাদেরও নামগুলো শোনানো হয়েছিল; কিন্তু তারা তা মনে রাখতে সক্ষম হয়নি। আদম (আ.)-কে মহান আল্লাহ সক্ষমতা দিয়েছিলেন। সুতরাং প্রথম মানব বাকশক্তিহীন ছিল, তাঁর কোনো ধর্ম বিশ্বাস ছিল না—জৈব বিবর্তনের এই যে মিথ্যা ও ভুল বিশ্বাস তা আমরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারি না। আল্লাহ আমাদের সঠিক বুঝ দান করুন। আমিন।